স্বামী শিষ্য সংবাদ ০৯

 নবম বল্লী 

স্থান—কলিকাতা 

বর্ষ-১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দ, মার্চ ও এপ্রিল 


স্বামী শিষ্য সংবাদ ০৯

স্বামীজীর স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে মতামত — মহাকালী পাঠশালা পরিদর্শন ও প্রশংসা — ভারতের স্ত্রীলোকদিগের অন্য দেশের সহিত তুলনায় বিশেষত্ব  স্ত্রীপুরুষ সকলকে সমভাবে শিক্ষা দেওয়া কৰ্ত্তব্য — সামাজিক কোন নিয়ম জোর করিয়া ভাঙ্গিবার প্রয়োজন নাই, শিক্ষার প্রভাবে লোকে মন্দ নিয়মগুলি স্বতঃই ছাড়িয়া দিবে। 



স্বামীজী আমেরিকা হইতে ফিরিয়া আসিয়া কয়েক দিন যাবৎ কলিকাতাতেই অবস্থান করিতেছেন। বাগবাজারের ৺বলরাম বসু, মহাশয়ের বাড়ীতেই রহিয়াছেন। মধ্যে মধ্যে পরিচিত ব্যক্তিদিগের বাটীতে ঘুরিয়াও বেড়াইতেছেন। আজ প্রাতে শিষ্য স্বামীজীর কাছে আসিয়া দেখিল, স্বামীজী ঐরূপে বাহিরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন। শিষ্যকে বলিলেন, “চল্–আমার সঙ্গে যাবি”—বলিতে বলিতে স্বামীজী নীচে নামিতে লাগিলেন; শিষ্যও পিছু পিছু চলিল। একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ীতে তিনি শিষ্য-সমভিব্যাহারে উঠিলেন ; গাড়ী দক্ষিণমুখে চলিল । 

শিষ্য। মহাশয়, কোথায় যাওয়া হইবে ? 

স্বামীজী। চল না দেখবি এখন । 

এইরূপে কোথায় যাইতেছেন তদ্বিষয়ে শিষ্যকে কিছুই না বলিয়া গাড়ী বিডন স্ট্রীটে উপস্থিত হইলে কথাচ্ছলে বলিতে লাগিলেন, “তোদের দেশের মেয়েদের লেখাপড়া শিখবার জন্য কিছুমাত্র চেষ্টা দেখা যায় না। তোরা লেখাপড়া ক'রে মানুষ হচ্ছিস কিন্তু যারা তোদের সুখদুঃখের ভাগী—সকল সময়ে প্রাণ দিয়ে সেবা করে, তাদের শিক্ষা দিতে—তাদের উন্নত করতে তোরা কি কচ্ছিস ?” 

শিষ্য। কেন মহাশয়, আজকাল মেয়েদের জন্য কত স্কুল, কলেজ হইয়াছে। কত স্ত্রীলোক এম-এ, বি-এ পাস করিতেছে । 

স্বামীজী। ও ত বিলাতি ঢং-এ হচ্ছে। তোদের ধর্ম্মশাস্ত্রাশাসনে, তোদের দেশের মত চালে কোথায় কটা স্কুল হয়েছে ? দেশে পুরুষদের মধ্যেও তেমন শিক্ষার বিস্তার নাই, তা আবার মেয়েদের ভিতর। গবর্ণমেণ্টের statistics-এ ( সংখ্যাসূচক তালিকায় ) দেখা যায়, ভারতবর্ষে শতকরা ১০/১২ জন মাত্র শিক্ষিত, তা বোধ হয় মেয়েদের মধ্যে one percent - ও ( শতকরা একজন ) হবে না । 

তা না হলে কি দেশের এমন দুর্দ্দশা হয় ? শিক্ষার বিস্তার—জ্ঞানের উন্মেষ—এসব না হলে দেশের উন্নতি কি করে হবে? তোরা দেশে যে কয়জন লেখাপড়া শিখেছিসদেশের ভাবী আশার স্থল—সেই কয়জনের ভিতরেও ঐ বিষয়ে কোন চেষ্টা উদ্যম দেখতে পাই না। কিন্তু জানি, সাধারণের ভিতর আর মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার না হলে কিছু হবার জো নেই । সেজন্য আমার ইচ্ছা আছে- কতকগুলি ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণী তৈরী করব। ব্রহ্মচারীরা কালে সন্ন্যাস গ্রহণ করে দেশে দেশে গাঁয়ে গাঁয়ে গিয়ে mass-এর ( জনসাধারণের ) মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে যত্নপর হইবে। আর ব্রহ্মচারিণীরা মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করবে। কিন্তু দেশী ধরণে ঐ কাজ করতে হবে। পুরুষদের জন্য যেমন কতকগুলি centre (শিক্ষাকেন্দ্র) করতে হবে, মেয়েদের শিক্ষা দিতেও সেইরূপ কতকগুলি কেন্দ্র করতে হবে। শিক্ষিতা ও সচ্চরিত্রা ব্রহ্মচারিণীরা ঐ সকল কেন্দ্রে মেয়েদের শিক্ষার ভার নেবে। পুরাণ, ইতিহাস, গৃহকাৰ্য্য, শিল্প, ঘরকন্নার নিয়ম ও আদর্শ চরিত্রগঠনের সহায়ক নীতিগুলি বর্তমান বিজ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্রীদের ধর্মপরায়ণ ও নীতিপরায়ণ করতে হবে। কালে যাতে তারা ভাল গিন্নী তৈরী হয়, তাই করতে হবে। এই সকল মেয়েদের সন্তান-সন্ততিগণ পরে ঐ সকল বিষয়ে আরও উন্নতি লাভ করতে পারবে। যাদের মা শিক্ষিতা ও নীতিপরায়ণা হন, তাদের ঘরেই বড় লোক জন্মায় । মেয়েদের তোরা এখন যেন কতকগুলি manufacturing machine ( কাজ করবার যন্ত্র ) করে তুলেছিস। রাম রাম! এই কি তোদের শিক্ষার ফল হল ? মেয়েদের আগে তুলতে হবে, mass-কে (আপামর সাধারণকে ) জাগাতে হবে, তবে ত দেশের কল্যাণ—ভারতের কল্যাণ । 

গাড়ী এইবার কর্নওয়ালিস ষ্ট্রীটের ব্রাহ্মসমাজ ছাড়াইয়া অগ্রসর হইতে দেখিয়া গাড়োয়ানকে বলিলেন, “চোরবাগানের রাস্তায় চল্ ।” গাড়ী যখন ঐ রাস্তায় প্রবেশ করিল, তখন স্বামীজী শিষ্যের নিকট প্রকাশ করিলেন, মহাকালী পাঠশালার স্থাপনকর্ত্রী তপস্বিনী মাতা তাঁহার পাঠশালা দর্শন করিতে আহ্বান করিয়া তাঁহাকে চিঠি লিখিয়াছেন। ঐ পাঠশালা তখন চোরবাগানে ৺রাজেন্দ্র মল্লিক মহাশয়ের বাড়ীর কিছু পূর্ব্বদিকে একটা দোতলা ভাড়াটিয়া বাড়ীতে ছিল। গাড়ী থামিলে দুই-চারি জন ভদ্রলোক তাঁহাকে প্রণাম করিয়া উপরে লইয়া গেলেন এবং তপস্বিনী মাতা দাড়াইয়া স্বামীজীকে অভ্যর্থনা করিলেন । অল্পক্ষণ পরেই তপস্বিনী মাতা স্বামীজীকে সঙ্গে করিয়া একটি ক্লাসে লইয়া গেলেন । কুমারীরা দাড়াইয়া স্বামীজীকে অভ্যর্থনা করিল এবং মাতাজীর আদেশে প্রথমতঃ ‘শিবের ধ্যান' সুর করিয়া আবৃত্তি করিতে লাগিল। পরে কিরূপ প্রণালীতে পাঠশালায় পূজাদি শিক্ষা দেওয়া হয়, মাতাজীর আদেশে কুমারীগণ তাহাই করিয়া দেখাইতে লাগিল । স্বামীজীও উৎফুল্ল মনে ঐ সকল দর্শন করিয়া অন্য এক শ্রেণীর ছাত্রীদিগকে দেখিতে চলিলেন। বৃদ্ধা মাতাজী স্বামীজীর সঙ্গে সকল ক্লাস ঘুরিতে পারিবেন না বলিয়া স্কুলের দুই-তিনটি শিক্ষককে আহ্বান করিয়া সকল ক্লাস ভাল করিয়া স্বামীজীকে দেখাইবার জন্য বলিয়া দিলেন। অনন্তর স্বামীজী সকল ক্লাস ঘুরিয়া পুনরায় মাতাজীর নিকটে ফিরিয়া আসিলে তিনি একজন কুমারীকে তখন ডাকিয়া আনিলেন এবং রঘুবংশের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকটির ব্যাখ্যা করিতে বলিলেন। ছাত্রীটিও উহার সংস্কৃতে ব্যাখ্যা করিয়া স্বামীজীকে শুনাইল। স্বামীজী শুনিয়া সন্তোষ প্রকাশ করিলেন এবং স্ত্রীশিক্ষাপ্রচারকল্পে মাতাজীর অধ্যবসায় ও যত্নপরতার এতদূর সাফল্য দর্শন করিয়া তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। মাতাজী তাহাতে বিনীতভাবে বলিলেন, "আমি ভগবতীজ্ঞানে ছাত্রীদের সেবা করিয়া থাকি, নতুবা বিদ্যালয় করিয়া যশোলাভ করিবার বা অপর কোন উদ্দেশ্য নাই ।” 

 বিদ্যালয়-সম্বন্ধীয় কথাবার্তা সমাপন করিয়া স্বামীজী বিদায় লইতে উদ্যোগ করিলে মাতাজী স্কুলসম্বন্ধে মতামত লিপিবদ্ধ করিতে দর্শকদিগের জন্য নির্দ্দিষ্ট বহিখানিতে ( Visitors' Book ) স্বামীজীকে মতামত লিখিতে বলিলেন। স্বামীজীও ঐ পরিদর্শক-পুস্তকে নিজ মত বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করিলেন। লিখিত বিষয়ের শেষ ছত্রটি শিষ্যের এখনও মনে আছে, তাহা এই— “The movement is in the right direction." 

অনন্তর মাতাজীকে অভিবাদনান্তে স্বামীজী পুনরায় গাড়ীতে উঠিলেন এবং শিষ্যের সহিত স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে নানা কথোপকথন করিতে করিতে বাগবাজার অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন । তাহারই যৎকিঞ্চিৎ বিবরণ নিয়ে লিপিবদ্ধ হইল । 

স্বামীজী। এঁর ( মাতাজীর ) কোথায় জন্ম ! সৰ্ব্বস্ব ত্যাগী তবু লোকহিতের জন্য কেমন যত্নবতী ! স্ত্রীলোক না হলে কি ছাত্রীদের এমন করে শিক্ষা দিতে পারে ? সবই ভাল দেখলুম; কিন্তু ঐ যে কতকগুলি গৃহী পুরুষ মাষ্টার রয়েছে —ঐটে ভাল বোধ হলো না। শিক্ষিতা বিধবা ও ব্রহ্মচারিণী-গণের উপরই স্কুলের শিক্ষার ভার সর্ব্বদা রাখা উচিত। এদেশে স্ত্রীবিদ্যালয়ে পুরুষ-সংস্রব একেবারে না রাখাই ভাল । 

শিষ্য। কিন্তু মহাশয়, গার্গী, খনা, লীলাবতীর মত গুণবর্তী শিক্ষিতা স্ত্রীলোক দেশে এখন পাওয়া যায় কৈ ! 

স্বামীজী। দেশে কি এখনও ঐরূপ স্ত্রীলোক নাই ? এ সীতা সাবিত্রীর দেশ, পুণ্যক্ষেত্র ভারতে এখনও মেয়েদের যেমন চরিত্র, সেবাভাব, স্নেহ, দয়া, তুষ্টি ও ভক্তি দেখা যায়, পৃথিবীর কোথাও তেমন দেখলুম না । ওদেশে ( পাশ্চাত্ত্যে ) মেয়েদের দেখে আমার অনেক সময় স্ত্রীলোক বলেই বোধ হত না—ঠিক যেন পুরুষ মানুষ ! গাড়ী চালাচ্ছে, অফিসে বেরুচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে, প্রফেসরী কচ্ছে ! একমাত্র ভারতবর্ষেই মেয়েদের লজ্জা, বিনয় প্রভৃতি দেখে চক্ষু জুড়ায়। এমন সব আধার পেয়েও তোরা এদের উন্নতি করতে পারলি নে । এদের ভিতরে জ্ঞানালোক দিতে চেষ্টা করলি নে। ঠিক ঠিক শিক্ষা পেলে এরা ideal ( আদর্শ ) স্ত্রীলোক হতে পারে । 

শিষ্য। মহাশয়, মাতাজী ছাত্রীদিগকে যে ভাবে জ্ঞান শিক্ষা দিতেছেন, তাহাতে কি ঐরূপ ফল হইবে ? এই সকল ছাত্রীরা বড় হইয়া বিবাহ করিবে, এবং উহার অল্পকাল পরেই অন্য সকল স্ত্রীলোকের মত হইয়া যাইবে । মনে হয়, ইহাদিগকে ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করাইতে পারিলে, তবে ইহারা সমাজের এবং দেশের উন্নতিকল্পে জীবনোৎসর্গ করিতে এবং শাস্ত্রোক্ত উচ্চ আদর্শ লাভ করিতে পারিত। 

স্বামীজী । ক্রমে সব হবে। দেশে এমন শিক্ষিত লোক এখন জন্মায় নি, যারা সমাজ-শাসনের ভয়ে ভীত না হয়ে নিজের মেয়েদের অবিবাহিতা রাখতে পারে। এই দেখ, না—এখনও মেয়ে বার তের বৎসর পেরুতে না পেরুতে লোকভয়ে-সমাজভয়ে বে দিয়ে ফেলে। এই সেদিন consent ( সম্মতি- সূচক ) আইন করবার সময় সমাজের নেতারা লাখ লোক জড় করে চেঁচাতে লাগল “আমরা আইন চাই না।” – অন্য দেশ হলে সভা করে চেঁচান দূরে থাকুক লজ্জায় মাথা গুজে লোক ঘরে বসে থাকত ও ভাবত আমাদের সমাজে এখনও এহেন কলঙ্ক রয়েছে ! 

শিষ্য। কিন্তু মহাশয়, সংহিতাকারগণ একটা কিছু না ভাবিয়া চিন্তিয়া কি আর বাল্যবিবাহের অনুমোদন করিয়াছিলেন ? নিশ্চয় উহার ভিতর একটা গূঢ় রহস্য আছে। 

স্বামীজী। কি রহস্যটা আছে ? 

শিষ্য। এই দেখুন, অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ দিলে, তাহারা স্বামিগৃহে আসিয়া কুলধর্মগুলি বাল্যকাল হইতে শিখিতে পারিবে। শ্বশুর-শাশুড়ীর আশ্রয়ে থাকিয়া গৃহকৰ্ম্ম-নিপুণা হইতে পারিবে। আবার পিতৃগৃহে বয়স্কা কন্যার উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা; বাল্যকালে বিবাহ দিলে তাহার আর উচ্ছৃঙ্খল হইবার সম্ভাবনা থাকে না ; অধিকন্তু লজ্জা, নম্রতা, সহিষ্ণুতা ও শ্রমশীলতা প্রভৃতি ললনা-সুলভ গুণগুলি তাহাতে বিকশিত হইয়া উঠে । 

স্বামীজী । অন্যপক্ষে আবার বলা যেতে পারে যে, বাল্যবিবাহে মেয়েরা অকালে সন্তান প্রসব করে অধিকাংশ মৃত্যুমুখে পতিত হয়; তাদের সন্তান-সন্ততিগণও ক্ষীণজীবী হয়ে দেশের ভিখারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কারণ, পিতামাতার শরীর সম্পূর্ণ সক্ষম ও সবল না হলে সবল ও নীরোগ সন্তান জন্মিবে কিরূপে ? লেখা-পড়া শিখিয়ে একটু বয়স হলে বে দিলে সেই মেয়েদের যে সন্তান-সন্ততি জন্মাবে, তাদের দ্বারা দেশের কল্যাণ হবে। তোদের যে ঘরে ঘরে এত বিধবা তার কারণ হচ্ছে—এই বাল্য-বিবাহ। বাল্য-বিবাহ কমে গেলে বিধবার সংখ্যাও কমে যাবে ।  

শিষ্য। কিন্তু মহাশয়, আমার মনে হয়, অধিক বয়সে বিবাহ দিলে মেয়েরা গৃহকার্য্যে তেমন মনোযোগী হয় না। শুনিয়াছি কলিকাতার অনেক স্থলে শাশুড়ীরা রাঁধে ও শিক্ষিতা বধূরা পায়ে আলতা পরিয়া বসিয়া থাকে। আমাদের বাঙ্গাল দেশে ঐরূপ কখনও হইতে পায় না ৷ 

স্বামীজী। ভাল মন্দ সব দেশেই আছে। আমার মতে সমাজ সকল দেশেই আপনা আপনি গড়ে। অতএব বাল্য-বিবাহ তুলে দেওয়া, বিধবাদের পুনরায় বে দেওয়া প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকার নেই। আমাদের কার্য হচ্ছে স্ত্রী, পুরুষ সমাজের সকলকে শিক্ষা দেওয়া। সেই শিক্ষার ফলে তারা নিজেরাই কোনটি ভাল কোনটি মন্দ, সব বুঝতে পারবে ও আপনারা মন্দটা করা ছেড়ে দিবে। তখন আর জোর করে সমাজের কোন বিষয় ভাঙ্গতে গড়তে হবে না। 

শিষ্য। স্ত্রীলোকদিগের এখন কিরূপ শিক্ষার প্রয়োজন ?  

স্বামীজী। ধৰ্ম্ম, শিল্প, বিজ্ঞান, ঘরকন্না, রন্ধন, সেলাই, শরীর-পালন—এই সকল বিষয়ের স্থূল স্থূল মর্ম্মগুলিই মেয়েদের শিখান উচিত। নভেল নাটক ছুঁতে দেওয়া উচিত নয়। মহাকালী পাঠশালাটি অনেকটা ঠিক পথে চলছে ; তবে কেবল পূজাপদ্ধতি শেখালেই হবে না ; সব বিষয়ে চোখ ফুটিয়ে দিতে হবে। আদর্শ নারীচরিত্রসকল ছাত্রীদের সামনে সর্ব্বদা ধরে উচ্চ ত্যাগরূপ ব্রতে তাদের অনুরাগ জন্মে দিতে হবে। সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, লীলাবতী, খনা, মীরা এঁদের জীবনচরিত্র মেয়েদের বুঝিয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের জীবন ঐরূপে গঠিত করতে হবে। 


গাড়ী এইবার বাগবাজারে বলরাম বসু মহাশয়ের বাড়ীতে পৌছিল। স্বামীজী অবতরণ করিয়া উপরে উঠিলেন এবং তাঁহার দর্শনাভিলাষী হইয়া যাঁহারা তথায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদের সকলকে মহাকালী পাঠশালার বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বলিতে লাগিলেন । 

পরে নূতনগঠিত ‘রামকৃষ্ণ মিশনের' সভ্যদের কি কি কাজ করা কর্তব্য, তদ্বিষয়ে আলোচনা করিতে করিতে 'বিদ্যাদান' ও 'জ্ঞানদানের' শ্রেষ্ঠত্ব বহুধা প্রতিপাদন করিতে লাগিলেন । শিষ্যকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “Educate, educate ( শিক্ষা দে, শিক্ষা দে ), নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেইয়নায়।” শিক্ষাদানের বিরোধী দলের প্রতি কটাক্ষ করিয়া বলিলেন, “যেন পেহলাদের দলে যাস্ নি।” ঐ কথার অর্থ জিজ্ঞাসা করায় স্বামীজী বলিলেন, “শুনিস্ নি ? 'ক' অক্ষর দেখেই প্রহ্লাদের চোখে জল এসেছিল তা আর পড়াশুনো কি করে হবে? অবশ্য প্রহ্লাদের চোখে প্রেমে জল এসেছিল ও মূর্খদের চোখে জল ভয়ে এসে থাকে । ভক্তদের ভিতরেও অনেকে ঐ রকমের আছে।” সকলে ঐকথা শুনিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন । স্বামী যোগানন্দ ঐ কথা শুনিয়া বলিলেন, “তোমার যখন যে দিকে ঝোঁক উঠবে তার একটা হেস্ত নেস্ত না হলে ত আর শাস্তি নাই; এখন যা ইচ্ছা হচ্ছে তাই হবে।”

-------::-------

Post a Comment

0 Comments