বাক্ সংযম - (জীবন সাধনার পথে)

    কাজের সময় অপ্রয়োজনীয় কথা বলিও না। এই জগতে যে যত বেশী অনাবশ্যক কথা বলে, সে-ই তত কম কাজ করিতে পারে । কারণ, অন্তরের যে শক্তি কর্ম্মরূপে পরিণত হইয়া জগতের অশেষ কল্যাণ সাধন করিতে পারিত, তাহাই বৃথাবাক্য বা বাগাড়ম্বরের ছিদ্র পথে নিঃশেষিত হইরা মানুষকে অন্তঃসারহীন, অকর্ম্মণ্য করিয়া ফেলে। উদ্দেশ্যহীন নিরর্থক বাক্যব্যয়ে মানুষের অন্তর ক্রমশঃ চঞ্চল ও দুর্বল হয় ; তখন সেই অবস্থায় যে কোন গভীর বিষয়ে মনোনিবেশ বা কোন কঠোর কাজে আত্মনিয়োগ করিতে পারে না। তখন তাহার অন-বরতই আত্মবিস্মৃতি ঘটিতে থাকে এবং সে সর্ব্বপ্রকারে নিতান্ত সাধারণ দায়িত্ব-বহনেরও অযোগ্য হইয়া পড়ে। শুধু তাই নয়, নিরন্তর অনাবশ্যক ও অবান্তর কথা বলার ফলে বিশেষ পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিও এমন হাল্কা হইয়া যায় যে সাধারণ লোকও তাহাকে অশ্রদ্ধা ও উপহাস করে, নিতান্ত আপনার জনও তাহার কথায় কোনও গুরুত্ব আরোপ করে না। 

    মানুষ যতই ধীর, স্থির ও সংযতবাক্ হইবে ততই তাহার বিচার নির্ভুল, প্রতিভা অম্লান, কর্ম্মশক্তি প্রখর, আত্মস্মৃতি জাগ্রত, বুদ্ধি নির্মল ও কর্তব্যবোধ সজাগ হইবে । 

    সংযতবাক্ ব্যক্তির কথার ভিতর দিয়া এত শক্তি সঞ্চারিত হয় যে, তাহার অন্যথাচরণ করা অপরের পক্ষে দুঃসাধ্য, এমন কি অসাধ্য হইয়া উঠে । সংযতবাক্ ব্যক্তির প্রত্যেকটি কথা অপরের প্রাণে শক্তির তাড়িৎ-প্রবাহ সৃষ্টি করে, সম্মোহন শক্তির মত সকলকে মুগ্ধ করিয়া সেই ভাবে কার্য করিতে বাধ্য করে। মনে প্রাণে সংযতবাক্‌ হইতে পারিলেই বাক্‌সিদ্ধি লাভ হয়। তখন মানুষ এত শক্তি লাভ করে যে মানুষ তো সাধারণ কথা, সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি পর্যন্ত তাঁহার আদেশ অবনত মস্তকে মানিয়া লইতে বাধ্য হয় । 

    ‘মা পৃষ্টঃ কস্যচিৎ ব্রুয়াৎ' - জিজ্ঞাসিত না হইয়া কাহারও সহিত কথা বলিবে না। জিজ্ঞাসিত হইলেও অবান্তর কথা এড়াইয়া চলিবে। নিতান্ত প্রয়োজনীয় কথাও যেটুকু না বললে নয়, ততটুকুই অতি ধীর, স্থির ও সংযতভাবে বলিবে। এই জন্য অপ্রয়োজনীয় লোকের সংস্রব হইতে যতটা সম্ভব দূরে থাকিবে। প্রত্যুষে উঠিয়া সংকল্প করিবে যে, আজ এতটি কথা বলিব এবং শয্যা গ্রহণ না করা পর্যন্ত এই সংখ্যা ঠিক রাখিব। এমনি ভাবে শুধু বাহ্যিক নয়, মনে প্রাণে, এমন কি বা কল্পনায়ও যখন অবান্তর কথা বলার প্রবৃত্তি জাগিবে না, অবান্তর চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনার তরঙ্গ পর্যন্তও যখন সম্পূর্ণরূপে তোমার অন্তর হইতে তিরোহিত হইয়া যাইবে*, তখনই তুমি ঠিক ঠিক সংযতবাক হইবে ; তখন সেই শুভ সময়ে তোমার চিন্তা ও বাক্যের অমোঘ শক্তি সমগ্ৰ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এক মহা আলোড়ন সৃষ্টি করিবে— সমগ্র বিশ্ববাসী তোমার মুখে একটি মাত্র কথা শুনিবার জন্য সর্ব্বদা উন্মুখ হইয়া থাকিবে। 


*জীবনের মহান আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনায় তন্ময় এবং সাধনায় একনিষ্ঠ হইতে পারিলে ধীরে ধীরে এই অবস্থা লাভ হইতে থাকে। 

Post a Comment

0 Comments