আদর্শ ও নীতি

     আদর্শ ও নীতিই মানুষের জীবনীশক্তি, প্রাণপ্রস্রবণ। প্রত্যেক মানুষ, সমাজ ও জাতি খাঁটি শক্তিমান হয়, সত্যিকার বাঁচা বাঁচিয়া থাকে তাহার শিক্ষা-সংস্কৃতি, আদর্শ ও নীতির অনুসরণের ভিতর দিয়া । যে মানুষ ও যে জাতি যতদিন পর্য্যন্ত তাহার মহান আদর্শ ও নীতিকে প্রাণপণে আকড়াইয়া ধরিয়া থাকে ততদিনই সে থাকে জগতের বুকে দুর্জয়, দুর্দ্ধর্ষ, দুরতিক্রম্য, অপরাজেয়। রাষ্ট্রীয় অধিকার স্খলিত হইলেও সতেজ প্রাণশক্তি তাহার দুর্ব্বল হয় না, কঠোর নির্যাতন নিপীড়নেও প্রবল জীবনীশক্তি কখনও লোপ পায় না । অটুট প্রাণ-শক্তির প্রাচুর্যে, মহান্ শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আদর্শের জীবন্ত প্রভাবে সে মরণজয়ী হইয়া মহাকালের বুকে নির্ভয়ে বীরের মত বিচরণ করে, স্বীয় বিজেতাকে পর্য্যন্ত আদর্শ-সমৃদ্ধ মহাজীবনের মন্ত্রে দীক্ষা দান করিয়া শিষ্যরূপে বরণ করিয়া লয়; জগতের ইতিহাস ইহার প্রত্যক্ষ সাক্ষী । 


    প্রকৃত মানুষ যে, মহান্ আদর্শ ও নীতিকেই সে জীবনের ধ্রুবতারা বলিয়া গ্রহণ করে । মৎস্য যেমন জলশূন্য হইয়া বাঁচিতে পারে না, প্রকৃত মানুষও তেমনি মহান্ আদর্শ ও নীতি ব্যতীত জীবন ধারণ করিতে সক্ষম হয় না। আদর্শনিষ্ঠ, নীতিপরায়ণ ব্যক্তি এই জন্য যে-কোন বিপদ বরণ করিয়া লইতে প্রস্তুত হয় ; কোন অত্যাচার উৎপীড়নকে সে ভয় করে না, লাঞ্ছনা নির্যাতনকে গ্রাহ্য করে না, মৃত্যু আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইলে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হাসিমুখে সাদরে তাহাকে আলিঙ্গন করে; কিন্তু জীবনের আদর্শকে কখনও সে পরিত্যাগ করে না। বিদ্যুদ্‌ঝলসিত, অশনিমন্দ্রিত কাল বৈশাখীর প্রলয়ঝঞ্ঝা মস্তকে ধারণ করিয়া, আততায়ীর গুপ্ত ছুরিকা পশ্চাতে রাখিয়া, শত্রুর শাণিত কৃপাণের মুখে নির্ভয়ে সে আগাইয়া চলে কৃপণের ধনের মত স্বীয় আদর্শ ও নীতিকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া। নিষ্ঠুর নির্যাতনের কণ্টক-মুকুট সে সানন্দে মাথায় তুলিয়া লয়, ‘সারকে’ অন্তরের গোপন অন্তরালে সযত্নে আগলাইয়া রাখিয়া অত্যাচারীর কোষমুক্ত উদ্যত তরবারির নিম্নে শির আগাইয়া দেয় ৷ 


    আদর্শের জন্য মরণ- সার্থক মরণ; সে তো মরণ নয়--- অমর জীবন। তাই বিপদের কৃষ্ণমেঘ যতই গাঢ়তর হয়, নির্যাতনের নির্মমতা যতই নিষ্ঠুরতর হইতে থাকে, আদর্শের পূজারী নিষ্ঠাবান্ সাধকের প্রাণমনও ততই বিপুল উল্লাসে মাতিয়া উঠে । তখন তাহার সেই বজ্রগম্ভীর হুঙ্কারে ভয় ভীত হইয়া পলায়ন করে, মৃত্যু আসিয়া "অন্তহীন প্রাণের” সন্ধান দিয়া বিদায় লয়, তার 'অমর মরণ' (রক্ত- বীজের মত) সহস্ৰ সহস্ৰ আদর্শপরায়ণ নূতন মানুষ সৃষ্টি করিয়া জাতির জীবনে অফুরন্ত প্রেরণার উৎসরূপে অক্ষয় হইয়া বাঁচিয়া থাকে। 


    মহান আদর্শের অনুশীলন, উত্তম নীতির অনুসরণ দ্বারাই মানুষ প্রকৃত মহৎ হয়, সমাজ ও জাতি প্রকৃত শ্রেষ্ঠতা অর্জ্জন করে। যে জাতি ও সমাজ যত বেশী উচ্চতম আদর্শসম্পন্ন মহামানব দান করিতে পারে, সে জাতি ও সমাজ মহত্তর নীতি ও আদর্শদ্বারা বৃহত্তম জনসমষ্টিকে উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত করিতে সক্ষম হয়, সেই জাতি ও সমাজই সমগ্র জগতের নিকট তত বেশী শ্রদ্ধা ও গৌরব লাভ করিয়া থাকে। জগৎ মানুষের পূজা করে না, পূজা করে মহান্ আদর্শের ; জগৎ মানুষকে শ্রদ্ধা দেখায় না, শ্রদ্ধা দেখায় শ্রেষ্ঠ মহত্ত্বকে। আদর্শহীন মানুষ—সে তো গলিত শব্, এজগতে কেহ তাহার দিকে ফিরিয়া তাকায় না। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ জন্মে, মরে; কি আসে যায় তাতে ? মানুষের মত মানুষ, খাঁটি আদর্শবান পুরুষ একজন জন্মিলে সমগ্র জগতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়, জাতির শিরায় শিরায় নব বসন্তের পুলক শিহরণ জাগে, সমাজের বুকে নূতন জীবনের স্পন্দন দেখা দেয়, দিকে দিকে দেশে দেশে মহাভাবের প্লাবন বহিয়া যায়, সমগ্র জগৎ সেই মহান্ ব্যক্তিত্বের শক্তিময় স্পর্শে সজীব হইয়া উঠে। তখন জাতীয় জীবনে এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা হয়, সহস্রাব্দের ঘুমন্ত জাতি জাড্যজড়তা বিষাদ-অবসাদ ঝাড়িয়া ফেলিয়া নূতন বিক্রমে জীবনের পথে অগ্রসর হইতে থাকে। সমগ্র মানব- জাতি নবজন্ম লাভ করিয়া ধন্য হয় ! 


    আত্মন্ ! প্রকৃত জীবন চাও ? তবে স্বীয় আদর্শকে প্রাণপণে আড়াইয়া ধরিয়া থাক । মানুষ চিরকাল বাঁচে না, আদর্শই চিরকাল বাঁচিয়া থাকে। বাঁচিতে হয় তো আদর্শকে নিয়া বাঁচিয়া থাক, মরিতে হয় তো আদর্শ নিয়াই মরিয়া যাও। জীবনে-মরণে, শয়নে - স্বপনে, জাগরণে বিচরণে আদর্শই তোমার সাথী, নীতিই পরম সুহৃদ, বন্ধু। আদর্শকে তুমি রক্ষা করিলে আদর্শও তোমাকে রক্ষা করিবে, নীতির ( Principle ) জন্য প্রাণ বলি দিলে শত শত প্রাণ তোমার পশ্চাতে দাঁড়াইবে। সুতরাং বৃথা মোহে মুগ্ধ না হইয়া, ভোগ-মরীচিকার পশ্চাতে না ছুটিয়া আদর্শের সাধনায় আত্মনিয়োগ কর, নীতিকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত কর ; তুমি কৃতার্থ হইবে, সমাজ ও জাতি নবজন্ম, নবজীবন লাভ করিয়া মহীয়ান গরীয়ান্ হইয়া উঠিবে। ওঁ শম্ ৷

Post a Comment

0 Comments