সঙ্কল্প-সাধনা - (জীবন সাধনার পথে)

    

    সঙ্কল্পই সাধকের জীবন, দৃঢ়প্রতিজ্ঞাই সঙ্কল্পের প্রাণ । জীবন- পথের তরুণ অভিযাত্রিগণ ! আজিকার এই শুভমুহূর্তে — নববর্ষের নূতন প্রভাতে তোমরা তোমাদের জীবনের সংকল্প-মন্ত্রকে আবার নূতন করিয়া ধ্যান কর । স্বর্ণকে যেমন অগ্নিতাপে শোধন পূর্বক মালিন্য দূর করিয়া উজ্জ্বল ও ব্যবহারোপযোগী করিয়া লইতে হয়, তেমনি মানুষের অভীষ্টসিদ্ধির সঙ্কল্পকেও প্রতিদিন, প্রতিমাস, প্রতি বর্ষের নবীন ঊষায় ধ্যানদ্বারা অবসাদ ও মালিন্য দূর করিয়া নূতন করিয়া জাগ্রত, জীবন্ত ও কার্যকরী করিয়া তুলিতে হয় । 


    স্বার্থ-কালিমাশূন্য, ইষ্টনিষ্ঠ, শুদ্ধ সাধকের নির্ম্মল হৃদয়ে যে পবিত্র সঙ্কর জাগ্রত হয় তাহা কখনও ব্যর্থ বা নিরর্থক হয় না ; তাই সিদ্ধি সেখানে সুনিশ্চিত। কিন্তু জড়ের মত নিশ্চেষ্ট বা উদাসীন থাকিলে অথবা কাপুরুষের মত শুধু ভাবিয়া ভাবিয়া কাল কাটাইলে চলিবে না । ইহার জন্য জীবন পণ করিতে হইবে, সৰ্ব্ব- প্রকার দুঃখদৈন্যকে বরণ করিয়া লইয়া উপযুক্ত মূল্য দিতে হইবে। “কখনও কোন মুহূর্তে যদি সঙ্কল্প হইতে বিচ্যুত হইতে হয়, তবে যেন তাহার পূর্ব্বে জীবন-লীলার অবসান হয়”- এমনিতর দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বলে সঙ্কল্পকে সর্ব্বদা সজাগ ও সচেতন রাখিতে হইবে । কেন না, আবদ্ধ ব্রত উদ্‌যাপন, আদর্শ জীবন-সাধনার সঙ্কল্প গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই সাধকজীবনে কঠোর অগ্নি-পরীক্ষা শুরু হয়। চতুর্দিক হইতে বাধাবিঘ্ন, বিপদাপদ আসিয়া সাধককে সঙ্কল্পচ্যুত করিবার জন্য প্রবলবেগে আক্রমণ করিতে থাকে। সময় সময় তাহা এমনি চরমে উঠে যে, সাধকের ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য, এমন কি অস্তিত্ব পর্যন্ত দলিয়া পিষিয়া গুড়াইয়া ফেলিবার উপক্রম করে। নিদাঘ-মধ্যাহ্নের প্রচণ্ড মার্তন্ড যেমন দিবাবসানে ক্লান্ত ও নিষ্প্রভ হইয়া পশ্চিম গগনে ঢলিয়া পড়ে, তেমনি সঙ্কল্প-সাধনার সাহসী সাধক, জীবন-পথের বীর অভিযাত্রীও সময় সময় আঘাত আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হইয়া ক্লান্তিভরে এলাইয়া পড়ে। তখন সেই নিদারুণ অবসাদের সময়, জীবনের সঙ্কল্পমন্ত্র বার বার স্মরণ ও গ্রহণ করিয়া, হতাশাচ্ছন্ন দুর্ব্বল মন-প্রাণকে সবল সুস্থ করিয়া বিজয়ী বীরের মত আবার অভীষ্ট সিদ্ধির পথে অভিযান করিতে হয়। 


    হতাশায় দমিও না, নিরাশায় ভাঙ্গিয়া পড়িও না, আঘাত আক্রমণে বিচলিত হইও না । সর্ব্বদা মনে রাখিও সীতার মত কঠোর অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, মহাবীর হনুমানের মত দুস্তর বারিধি অতিক্রম করিয়াই তোমাকে সঙ্কল্পের সাধনায় সাফল্য লাভ করিতে হইবে। প্রতিনিয়ত শয়নে, স্বপনে, জাগরণে ধ্যান করিও — প্রহ্লাদের দৃঢ়তা,  আর তথাগত বুদ্ধের সেই মহাসঙ্কল্পমন্ত্র ———


“ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং, 

ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু । 

অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্প-দুর্লভাং 

নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে ॥' 


    শরীর শুষ্ক হয় হউক, অস্থি-চৰ্ম্ম-মাংস ধ্বংস হইয়া যায় যাউক, তথাপি সেই বহু কল্পদুর্লভ বোধি (আত্মজ্ঞান) লাভ না করিয়া কিছুতেই আমি এই আসন ত্যাগ করিব না । 


    এই প্রকার বজ্রদৃঢ় সঙ্কল্পের বলে ভগবানের আসন টলিয়া উঠে, তিনি স্বয়ং আসিয়া সাধকের কণ্ঠে সিদ্ধির জয়-মাল্য পরাইয়া সঙ্কল্প- সাধনার গৌরব দান করেন । 


    ইহা শুধু স্তোকবাক্য নয়, সাধক- জীবনে বহুপরীক্ষিত নানাভাবে উপলব্ধ বাস্তব সত্য । 

Post a Comment

0 Comments