জীবন-লক্ষ্য - (জীবন সাধনার পথে)

    ক্ষুদ্র বীজের ভিতর যেমন মহামহীরুহের বিরাট কারা আত্মসঙ্কোচ করিয়া লুক্কায়িত থাকে, তেমনি এই ক্ষুদ্র মানুষের ভিতরও আত্মসঙ্কোচ করিয়া ঘুমাইয়া থাকে তাহার অনন্ত শক্তিমান ভূমা আত্মা। অপরি-স্ফুট সঙ্কুচিত কোরকের বুকে সুপরিস্ফুট পুষ্পের সৌন্দর্য্য শুষমার আত্ম-গোপনের মত এই ক্ষুদ্র অবিকশিত মানবশিশুর ভিতরেই মহামানবের অপূর্ব্ব মহত্ত্ব ও দেবোপম চরিত্রমাধুর্য্য আত্মগোপন করিয়া থাকে। এই সঙ্কুচিত ঘুমন্ত মহান আত্মসত্তাকে জাগ্রত করিয়া মানুষের বিরাট সম্ভাবনাকে সুপরিস্ফুট সুপরিণত রূপ দেওয়াই জীবনের চরম সার্থকতা। মানুষ যখন তাহার বিরাট ভূমাস্বরূপকে উপলব্ধি করে, তখন সে আর দ্বন্দ্বমোহগ্রস্ত, কামনা-বাসনা-তাড়িত, রিপু-ইন্দ্রিয়- শাসিত, রোগ-শোক-কাতর, মরণ-ভীরু দুর্বল মানুষ নয়, তখন সে দুঃখ-শোক-মোহাতীত, জরাব্যাধিযুক্ত, রিপু-ইন্দ্রিয়-শাসক মৃত্যুঞ্জয়ী মহাবীর। জগতের কোন শক্তি তখন তাহাকে শাসন করিতে পারে না, কোন প্রলোভন তাহাকে প্রলুব্ধ করিতে সক্ষম হয় না, কোন দুঃখ-দৈন্য, অসুখ-অশান্তি, পাপতাপ, ভয়-ভাবনা নিকটে আসিতে সাহস পায় না; প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাটের পদতলে লুন্ঠিত ভৃত্যের মত সমস্ত বিরুদ্ধশক্তি সসম্ভ্রমে আসিয়া তাহার পদমূলে আশ্রয় ভিক্ষা করে, মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্ব গঙ্গা যমুনার পবিত্র ধারার মত পরস্পর সম্মিলিত হইয়া তাহার জাগ্রত ভূমাস্বরূপে মিশিয়া সাগর-সঙ্গমের পুণ্যতীর্থ সৃষ্টি করে । 

        “ভূমৈব সুখং নাল্পে  সুখমস্তি।” ভূমা বিরাট মহান যাহা, তাহাতেই সুখ শান্তি আনন্দ ; আর অল্প সামান্য ক্ষুদ্র যাহা', তাহাতেই শোক-দুঃখ-অসুখ-অশান্তি। 

“যো বৈ ভূমা তদমৃতমথ, যদল্পং তন্ম তত্রম ।” 


        ভূমার ভিতরে মহানের ভিতরে অমৃতত্ত্ব—চির অমরত্বের অক্ষয় বীজ নিহিত, আর অল্প সামান্য সঙ্কীর্ণতার ভিতরেই সুনিশ্চিত ধ্বংস, মহামৃত্যু। অনন্ত, শক্তির আধার মানুষ যখন তাহার এই বিরাট, স্বরূপ ভুলিয়া, চরম দুর্ভাগ্যবশে জীবনের এক অসাবধান দুর্ব্বল মুহূর্তে নিজেকে 'অল্পে'র (সঙ্কীর্ণতার) মধ্যে আবদ্ধ করিয়া পিঞ্জরাবদ্ধ হয়, তখন সে, শুধু তার আত্মশক্তির অপব্যবহার ও আত্মসত্তাকে লাঞ্ছনা ও অপমানই করে না, মহামৃত্যুকে বরণ করিয়া লইয়া করে চিরঘৃণ্য নির্লজ্জ আত্মহত্যা। যে মানুষ অসামান্য পৌরুষবলে অসাধ্য সাধন করিয়া সমগ্র জগতে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করিবার মত শক্তিসম্পন্ন, যার তপোলব্ধ অত্যদ্ভূত বীর্যবিভূতি বিশ্ব প্রকৃতিকে আয়ত্তে আনিয়া ইঙ্গিতে পরিচালন করিতে সমর্থ, যাহার সুবিকশিত জাগ্রত ব্যক্তিত্বের বিপুল প্রভাব সর্ব্বধ্বংসী মহাকালকেও অগ্রাহ্য করিয়া জগতের বুকে অক্ষয় আসন প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম, সেই দুর্জ্জয় শক্তির আধার মানুষ যদি তার সমস্ত শক্তি স্বীয় উদরপূর্তি ও নিদ্দিষ্ট মুষ্টিমেয় কয়েকটি লোকের ভরণ-পোষণে সীমাবদ্ধ করে, তবে তাহা আত্মহত্যা নয় তো কি? যে মানুষ সমগ্র বিশ্বমানবকে শাশ্বত শান্তি ও কল্যাণের অমৃতান্ন পরিবেশনে পরিতৃপ্ত করিয়া চিরন্তন অশান্তির দাবদাহ নিৰ্ব্বাপিত করিবে, সে যদি শুধু ইন্দ্রিয়-সুখ-সম্ভোগ-চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে তবে তাহা কি তাহার সামর্থ্যের অপচয় নয় ? 


শুধু আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুনই কি জীবনের একমাত্র কাম্য কৰ্ম্ম ? শুধু রিপু-ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব ও পাশবিক বৃত্তির চরিতার্থতায়ই কি "একমাত্র তৃপ্তি ? একমাত্র সুখ ? । মানুষ কি কেবল ইহার জন্যই জন্মগ্রহণ করে ও বাঁচিয়া থাকে? না, তাহার জীবনের অন্য কোন শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য, মহত্তর প্রয়োজন আছে ? স্বেচ্ছাবিচরণশীল প্রচণ্ড প্রতাপশালী পশুরাজ সিংহের শৃঙ্খলিত জীবনই কি বাঞ্ছনীয় ? অনন্ত আকাশে উডডীয়মান স্বাধীন বিহঙ্গের পিঞ্জরাবদ্ধ জীবনই কি শান্তিদায়ক ? স্বর্ণ-পিঞ্জর, স্বর্ণশৃঙ্খল, অনায়াস-লব্ধ আহার্য্য ও লোকের মনোরঞ্জনই কি তাহার নিকট তৃপ্তিকর ? আত্মন ! একবার ধীরভাবে, শান্ত মনে স্থির মস্তিষ্কে চিন্তা করিয়া দেখ । 


দাসত্বভাবসম্পন্ন দুর্ব্বল মানুষ বা জাতি যেমন পরাধীনতার অহিফেন সেবন করিয়া স্বাধীন জীবনের শান্তি ও আনন্দ ভুলিয়া যায় এবং পরাধীনতাকেই একমাত্র শান্তির কারণ বলিয়া মনে করে, তেমনি ঐন্দ্রিয়ক সুখ সম্ভোগে মত্ত, মোহাভিভূত মানুষও ইন্দ্রিয়াতীত ভূমার অনন্ত শান্তি-পারাবারের কথা ভুলিয়া একমাত্র ক্ষণভঙ্গুর ‘আপাত-মনোরম পরিণাম ভয়াবহ’ ভোগ সুখকেই প্ৰকৃত সুখ বলিয়া ভুল করে । কিন্তু যে মুহূর্তে মহাকালের নির্মম আঘাতে বিষয়সম্ভোগরূপ রঙ্গীন নেশা ছুটিয়া যায়, সদ্যধৃত পাশবদ্ধ কেশরীর মত বদ্ধজীবনের বন্ধন-বেদনায় মানুষ অস্থির চঞ্চল হইয়া উঠে, তখন সেই মুহূর্ত্তে “নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী” — সিংহ যেমন সরোষে পিঞ্জর ভঙ্গ করিয়া মুক্ত প্রান্তরে বাহির হইয়া আসে, ইন্দ্রিয়পাশবদ্ধ মানুষও তেমনি সংসারজাল ছিন্নভিন্ন করিয়া ত্যাগের পথে শান্তির রাজ্যে ছুটিয়া আসে, সর্ব্ববন্ধনমুক্ত স্বাধীন জীবনের নিরবচ্ছিন্ন অনাবিল আনন্দ আস্বাদন করিয়া ধন্য ও কৃতার্থ হয়। শুধু তাই নয়, এতদিন সে ভ্রান্তির ঘোরে মোহের বশে যে রিপু-ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করিতেছিল, সেই রিপু-ইন্দ্রিয়ই অনুগত ভৃত্যের মত তাহার আদেশ পালন করিতেছে দেখিয়া এবং প্রভু হইয়াও সে যে এতদিন তাহারই ভৃত্যের দাসত্ব করিয়াছে তাহা বুঝিতে পারিয়া বিস্মিত ও লজ্জিত হয় । 


আত্মন ! সর্ব প্রকার দাসত্ব, পরাধীনতা ও আত্মবিস্মৃতির মোহ-কবল হইতে আত্মোদ্ধার করিয়া অন্তর্নিহিত সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করিয়া তোল, ইহার জন্য যত কঠোর মূল্যই প্রয়োজন হউক না কেন তাহা দিতে প্রস্তুত হও । আজ যাহা দুঃসাধ্য বা অসম্ভব বলিয়া মনে হইতেছে, তাহাই নিরন্তর সাধনা ও অভ্যাসের ফলে একদিন সুসাধ্য ও সম্ভব হইয়া উঠিবে । তবে ইহার জন্য চাই বিরাট উদ্যোগ, অনন্ত অসীম ধৈর্য্য, অদম্য অফুরন্ত উৎসাহ, উদ্যম, অধ্যবসায়। জীবনের লক্ষ্য-সাধনায় সিদ্ধ পূর্বতন কৃর্তী মহামানবদের ভিতর যে শক্তিসামর্থ্য ছিল, তোমার ভিতরেও সেই শক্তিসামর্থ্যই বিদ্যমান। এখন চাই ( তাঁদের মত ) শুধু সদগুরুর আশ্রয় গ্রহণ করিয়া তাঁহারই নির্দ্দিষ্ট পথে চলিয়া সেই শক্তির অনুশীলন, কার্য্য সিদ্ধির উপযোগী কঠোর আত্মত্যাগ, সাধনা ও দুঃখ-কষ্ট বরণ । 


সাময়িক দুঃখ-দুর্ব্বলতা বা প্রাথমিক অকৃতকার্য্যতায় হতাশ হইও না। কঠোর প্রতিজ্ঞ' ও বজ্রদৃঢ় সঙ্কল্প সহকারে লক্ষ্য-সাধনে প্রবৃত্ত হও । মনে রাখিও - 

“উদয়তি যদি ভানু পশ্চিমে দিগ বিভাগে, 

বিকশতি যদি পদ্মং পৰ্ব্বভানাং শিখরাগ্রে। 

প্রচলতি যদি মেরুঃ শীততাং যাতি বহ্নি , 

ন চলতি খলু বাক্যং সজ্জনানাং কদাচিৎ ।।” 


সূর্য্য যদি পশ্চিম দিকে উদিত হয়, পৰ্ব্বত শিখরে যদি পদ্ম প্রস্ফুটিত হইতে আরম্ভ করে, মেরু পর্বত যদি স্থানান্তরে গমন করে এবং অগ্নিও যদি শীতলতা প্রাপ্ত হয় তথাপি প্রকৃত সজ্জনের বাক্য কখনও অন্যথা হয় না । 


— লক্ষ্য-সাধনের এই দৃঢ়তাই মানুষকে সিদ্ধির গৌরব দান করে ।

Post a Comment

0 Comments